সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল জলিল প্রধান ১৯৫২ সালে অত্র ইউনিয়নের কুয়াতপুর হামিদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোঃ ইউসুফ প্রধান এবং মায়ের নাম মোছাঃ বিবিজান নেসা।
তিনি চতরা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পড়াশুনা করেন এবং পলাশবাড়ি সরকারি কলেজ হতে উচ্চমাধ্যমিক ও বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মমূলক পেশা হিসেবে তিনি অভিজাত ভূমি অধিকারী ছিলেন এবং নিজস্ব কিছু ব্যবসা ছিল।
তিনি ছোটবেলা থেকেই রাজনীতিমনা ছিলেন এবং অনন্য নেতৃত্বের গুণের অধিকারী ছিলেন। সততা, সত্যে নির্ভীক, নিঃস্বার্থ মানসিকতা, পরোপকার, দানশীলতা, সহযোগিতাপূর্ণ আন্তরিক ব্যবহার ইত্যাদি ছিল তার নেতৃত্ব ও মানবিক আদর্শের উপাদান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭৩ সালে তিনি ১৪ নং চতরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং পরপর তিন মেয়াদে মোট ১৮ বছর চেয়ারম্যান হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর জাতীয় পার্টির হয়ে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে তিনি ১৯৮৬ সালে এবং ১৯৮৮ সালে পরপর দুইবার রংপুর-৬ আসন (পীরগঞ্জ) এর সাংসদ নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন।
জনাব আব্দুল জলিল সাহেবের অনন্য গুণ ছিল তার দানশীলতা। ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মতো লুকিয়ে নিজের ঘর হতে আশেপাশের দরিদ্র ও অসহায় মানুষদেরকে চাল, গম ইত্যাদি খাদ্য দান করতেন।
এছাড়াও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পূর্ব হতেই তিনি এলাকার মানুষজনকে বিবাহ বিষয়ে সর্বাত্মক সাহায্য করতেন এবং চিকিৎসা সহায়তা, মৃতের অন্তেষ্টিক্রিয়া ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে এলাকার মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তার কাছে কেউ সাহায্যের জন্য গেলে খালি হাতে ফিরে আসতো না।
সংসদ সদস্য হওয়ার পর তিনি এলাকার বহু মানুষকে চাকরি লাভের বিষয়ে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।
তার সুহৃদ্যতা ছিল অনন্য। তার সঙ্গে কেউ দেখা করতে গেলে অন্তত চা বিস্কুট খাওয়াতেন। সমকালীন সময়ে এলাকার অভাবী ও সমস্যাগ্রস্থ মানুষদের কাছে তিনি দেবদূতের মতো কিংবদন্তি ছিলেন। তিনি সংসদ সদস্য থাকাকালীন সময়ে কেউ যদি হঠাৎ কোনো দরকারে ঢাকায় গিয়ে সেখানে কোথাও থাকার ব্যবস্থা না থাকতো তার থাকার ব্যবস্থা তিনি করতেন এবং যে কাজে গিয়েছেন সেই কাজেও তিনি তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। এজন্য তিনি ঢাকায় একটি বেশ বড়সড় ফাঁকা বাড়িই ভাড়া নিয়েছিলেন যাতে এলাকার কেউ ঢাকায় গেলে অস্থায়ীভাবে সেখানে থাকতে পারেন।
তার এতোটাই জনপ্রিয়তা ছিল যে, যদিও সেই সময়ে মুঠোফোনের যুগ ছিল না তথাপি তিনি কবে বাড়ি ফিরবেন এই তথ্য কোনোভাবে ছড়িয়ে গেলে বাস হতে নামার পর তাকে ধাপেরহাট বাসস্ট্যান্ড হতে বাড়ি আনার জন্য বেশ অনেকজন ভ্যান-রিকশাওয়ালা অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তখন তিনি যার ভ্যান/ রিকশায় উঠতেন সেই রিকশাচালক নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করতো। আর অন্যান্য যারা তাকে আনতে গিয়েছিল তাদেরকেও তিনি ভালোবেসে সমপরিমাণ ভাড়া দিয়ে দিতেন।
যাপিত জীবনে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন মানুষের মাঝে। অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন তিনি। সেসময় তার মাধ্যমে চতরা সারাদেশে পরিচিত হয়েছিল। চতরা বলতে তখন আব্দুল জলিল সাহেবের এলাকা বোঝাতো। তার হাত ধরে বেগম আলেয়া জলিল পরপর দুইবার চতরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
অদ্যাবধি দৃশ্যমান এরূপ অবদান হিসেবে সংসদ সদস্য থাকাকালীন সময়ে তিনি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হাতে নেন এবং অত্র ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য রাস্তায় ৮০ হাজার নারকেল গাছ রোপণ করেন। বৃক্ষপ্রেমিক এই মানুষটি এভাবে বৃক্ষসম্পদের উৎকর্ষ সাধন করে হয়ে উঠেছিলেন গ্রিন চতরার রূপকার। এজন্য ১৯৮৭ সালে তিনি রাজশাহী শিশু একাডেমি থেকে পুরস্কার লাভ করেন এবং বৃক্ষরোপণের জন্য জাতীয় রৌপ্যপদক লাভ করেছিলেন।
এছাড়াও তিনি বন্যাপ্রবণ চতরা ইউনিয়নের বন্যার ক্ষতি হ্রাসের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছিলেন।
২০০৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শুক্রবার দিবাগত রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
জনাব আব্দুল জলিল সাহেবের স্বপ্ন ছিল এলাকার দারিদ্র্য বিমোচন, কুটির শিল্পের উন্নয়ন, মানুষের কর্মসংস্থান ইত্যাদি। সেজন্য তিনি চতরায় বিস্কুট, লজেন্স, পাউরুটি, আইসক্রিম ইত্যাদির কারখানা স্থাপন করেছিলেন এবং এলাকায় পশুসম্পদ সমৃদ্ধির জন্য ছাগলের খামার করে ছাগল পালন সম্প্রসারণ করেছিলেন এবং তার চালের মিল ও অন্যান্য কিছু কারখানাও ছিল। উদ্ভাবনী চিন্তা হিসেবে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে জাজিম ইত্যাদি জিনিসপত্র তৈরির কারখানা স্থাপনের স্বপ্ন ছিল।
এমন একজন আদর্শ মানুষকে আমরা আনাদিকাল মনে রাখতে চাই, তাকে স্বপ্নে দেখতে চাই, নিভৃত চিন্তায় কোনো এক উদাস মুহূর্তে তার মুখখানা মনে করতে চাই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তার গল্প বলতে চাই। এই চতরায় তার মতো এমন আরও অনেক আদর্শ মানুষের জন্ম হোক।
* তথ্যসুত্র : বেগম আলেয়া জলিল এবং স্থানীয় জনসাধারণ।
© সম্পাদনা : মেহেদী হাসান, বিএ অনার্স, এমএ (ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব), বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর; প্রতিষ্ঠাতা, চতরাপিডিয়া।
এছাড়াও উনার জীবনী নিয়ে একটি বই লেখা হয়েছে এবং সেটি প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বইটি প্রকাশিত হলে সেটির পিডিএফ কপি এখানে আপলোড করা হবে।
Note : যারা ব্রাউজার থেকে কিংবা অন্য অ্যাপ থেকে চতরাপিডিয়া ভিজিট করছেন তারা 'চতরাপিডিয়া' অ্যাপ ডাউনলোড করতে এখানে—ক্লিক—করুন।
No comments:
Post a Comment