রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার ১৪ নম্বর ইউনিয়নটি '১৪ নং চতরা ইউনিয়ন' নামে পরিচিত। চতরা ইউনিয়নের নামকরা স্থান হলো ঐতিহ্যবাহী চতরাহাট। এছাড়াও চতরা ইউনিয়নে রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন 'নীল দরিয়া' যা ছিল মধ্যযুগের এক নৃপতির পরিখাবেষ্টিত দূর্গ।
[] চতরা নামের উৎপত্তি: চতরা ইউনিয়নের 'চতরা' নামটির উৎপত্তি যথাসম্ভব মধ্যযুগে। একটা বইয়ে পাওয়া যায় সে অনেক আগের রাজাদের আমলের কথা। চতরায় যে বিজেএমসি ছিলো তার উত্তরপূর্ব দিক থেকে শুরু করে প্রয়াত সাবেক সাংসদ আব্দুল জলিল প্রধানের বাড়ির পিছন পর্যন্ত একটা বিশাল চত্বর ছিলো যেখানে ঘোড়দৌড় হতো, ঘোড়ায় চড়া শেখানো হতো। এই চত্বরটা খুব নামকরা ছিলো; তখন হাট/বাজার ছিলো অন্যত্র অর্থাৎ পুরাতন ব্রিজের দক্ষিণের জায়গাটাকে সে আমলের মানুষেরা হাটখোলা বলতো। পুরাতন হাট সেখানেই বসতো কিন্তু চত্বরটা বিশাল এবং নান্দনিক ছিল বলে লোকজন সেখানে প্রায়শই যাতায়াত করতো। যাবার সময় বা কেউ আগে গেলে বলতো চত্বরে যাবো বা চত্বরে গেছে। চত্বরে যাই, যাচ্ছি এসবের এই চত্বর থেকেই চত্তরা > চত্রা > থেকেই বর্তমান 'চতরা' এর উৎপত্তি বলেই সেই বইটিতে জোরালোভাবে বলা হয়েছিলো। একটু উত্তরে হাতিকুড়া নামে একটা জায়গা ছিলো (বর্তমান খালাশপীর রোডের মালোপাড়ার পূর্বদিকে) সেখানে রাজার হাতিকে স্নান করানো/ পানি খাওয়ানো হতো। পরবর্তীতে বৃটিশ আমলে হাতিকুড়ার উত্তরদিকে নীলকুঠি গড়ে উঠেছিলো। সেখানে একটা জায়গায় মন্দিরের মতো একটা জায়গা যা দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে রেকোর্ডেড। এখন তার চিহ্নও নাই। তবে ছোটবেলায় আমিও ওখানকার মন্দির ও নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ দেখেছি।
চতরার ইতিহাস নিয়ে একসময় অনেক ঘাটাঘাটি করতাম। বইয়ের ফটোকপি ও সংগৃহীত কাগজগুলো ৯৬ এর বন্যায় ভিজে ধবংস হয়ে গেছে অনেক দূর্লভ ছবিসহ।
* তথ্যসূত্র : আব্দুর রব প্রধান, অধ্যক্ষ, চতরা বিজ্ঞান ও কারিগরি কলেজ।
[] চতরা ইউনিয়নের অবস্থান, আয়তন ও জনসংখ্যা: চতরা ইউনিয়ন পীরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণাংশে অবস্থিত; এর পূর্বে কাবিলপুর ইউনিয়ন, উত্তরে বড় আলমপুর ইউনিয়ন এবং পশ্চিম ও দক্ষিণে করতোয়া নদী এবং নদীর ওপারে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট। চতরা ইউনিয়নের আয়তন ৩৪.৯৭ বর্গকিলোমিটার এবং উক্ত ইউনিয়নে ২৪টি মৌজা রয়েছে। ইউনিয়নটির জনসংখ্যা ২০১১ সালের আদমশুমারীতে ছিল ৩০৬০৩ জন।
* তথ্যসূত্র : ১৪ নং চতরা ইউনিয়ন পরিষদ ওয়েবসাইট।
[] ঐতিহ্যবাহী স্থান: চতরা ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী স্থান 'চতরা হাট'। রংপুরের পীরগঞ্জে নীলাম্বর রাজার নীল দরিয়া পরিখার পাশে করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী চতরা হাট। বারোয়ারি হাট হিসেবেই পরিচিত এ হাট। ব্রিটিশ আমলে জামালপুর, গাইবান্ধা, নারায়ণগঞ্জ থেকে বড় ব্যবসায়ীরা করতোয়া নদী দিয়ে নৌকাযোগে এ হাটে আসতেন। তারা হাট থেকে ধান, গম, পাট কিনে নিয়ে যেতেন।
পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক সংলগ্ন ধাপেরহাট বাসস্ট্যান্ড থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে চতরা হাটের অবস্থান। দুদিক থেকে দুটি পাকা সড়ক মিশেছে চতরা হাটে। এছাড়াও হাট হতে একটি সড়ক চতরা টু খালাশপীর এবং অন্য একটি সড়ক চতরা হতে ঘোড়াঘাটে চলে গেছে। রাজা নীলাম্বর রাজ্য পরিচালনার জন্য রাজ্যকে কয়েক অংশে ভাগ করে নায়েবদের ইজারা দেন। এ হাট এলাকায় একসময় একটি বৃহৎ চত্বর ছিল। সেই 'চত্বর' থেকেই বর্তমান চতরা নামের উৎপত্তি যা ইতোপূর্বেই বলা হয়েছে।
প্রায় ২৭ বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে চতরা হাটটি। শত বছরের বেশি বয়স এ হাটের। শুক্র ও মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত হাটে বেচাকেনা চলে। এছাড়া প্রতিদিনই বসে বাজার। একসময় জামালপুর, গাইবান্ধা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে বড় ব্যবসায়ীরা করতোয়া নদী দিয়ে নৌকায় করে আসতেন। তারা এ হাট থেকে ধান, গম, পাট কিনে নৌকায় ভরে নিয়ে যেতেন। হাটে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) ক্রয়কেন্দ্র ছিল। আদমজী পাটকল বন্ধ হয়ে গেলে ক্রয়কেন্দ্রটি অব্যবহৃত পড়ে থাকে।
চতরা হাটে ধান, পাট ও ভুট্টার পৃথক আড়ত আছে। এখনও বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এখানে আসেন। কেননা এ হাটে পণ্যের দাম তুলনামূলক কম। সবজিসহ যাবতীয় কাঁচা পণ্য পাওয়া যায়। সব ধরনের পণ্যই ফরমালিনমুক্ত ও টাটকা। হাটবারে ২০ থেকে ২৫ ট্রাক সবজি ও ধান কিনে নিয়ে যান পাইকাররা। পাট ও ভুট্টার মৌসুমে জমে এ দুটি আড়ত। বিদ্যুৎসহ সব ধরনের আধুনিক ব্যবস্থা থাকায় বাইরের পাইকাররা আসেন হাটে।
হাটের কিছু সমস্যাও রয়েছে। প্রধান সমস্যা উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা। পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা উন্নত নয়, তবে সম্প্রতি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। করতোয়া নদী ও নীল দরিয়ার কারণে এ অঞ্চলে মাছের আধিক্য রয়েছে। কিন্তু হাটে মাছের আড়ত না থাকায় মাছ ব্যবসায়ীরা রংপুর কিংবা বগুড়ায় গিয়ে মাছ বিক্রি করেন। মাছের আড়ত হলে ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটবে বলে মনে করেন হাট সংশ্লিষ্টরা।
* তথ্যসূত্র : অনলাইন এবং স্থানীয় তথ্যসংস্থান।
[] প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন: চতরা ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন 'নীল দরিয়া'। নীল দরিয়া রংপুর জেলার পীরগঞ্জের একটি অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি ছিল মধ্যযুগের প্রতাপশালী হিন্দু নৃপতি নীলাম্বর সেনের একটি দুর্গ। নীলাম্বর সেনের শাসনের অবসানের পর বহুকাল ধরে পরিচর্যার অভাবে নীল দরিয়ার অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এটি বর্তমানে এ অঞ্চলের একটি বিনোদনকেন্দ্র।
এটি রংপুরের পীরগঞ্জ থানার চতরা ইউনিয়নে অবস্থিত। এটি চতরাহাট থেকে পশ্চিমে হাফ কিলোমিটার দূরে।
নীল দরিয়া হচ্ছে একটি গভীর ও প্রশস্ত বৃত্তাকার খাল যা দ্বারা একটি স্থলভূমি বেষ্টিত; যেখানে ৯২ একরজুড়ে খাল এবং ৪৮ একরজুড়ে স্থলভাগ রয়েছে। স্থলভাগে দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, বাগান, টিলা, খেলার মাঠ ইত্যাদি জিনিস ও জীববৈচিত্র রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, নীল দরিয়াকে কেন্দ করে কোনো পর্যটন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। তাই এখানে কোনো নৌকা ভ্রমণের সুবিধা নেই। নীল দরিয়ার নৌকাভ্রমণ করতে হলে নৌকায় চড়ে মাছধরা জেলেদের সাথে চুক্তি করতে হবে।
নীল দরিয়ার আশেপাশে কোনো হোটেল ও রিসোর্ট নেই। এই সেবা পেতে হলে আপনাকে পীরগঞ্জ উপশহরে যেতে হবে।
এখানে কোনো রেস্টুরেন্ট সেবাও নেই; শুধু একটি চা-নাস্তা ও হালকা খাবারের দোকান আছে। রেস্টুরেন্ট সেবা পেতে হলে আপনাকে চতরাহাটে আসতে হবে।
সম্প্রতি নীল দরিয়াকে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
* তথ্যসূত্র : 'নীল দরিয়ায় ইতিকথা' বই এবং অনলাইন।
এ অঞ্চলে চতরার নামে আছে চতরাহাট, চতরা উচ্চ বিদ্যালয়, চতরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চতরাহাট দাখিল মাদ্রাসা, চতরা ডিগ্রি কলেজ, চতরা বিজ্ঞান ও কারিগরি কলেজ এবং চতরা মাল্টিমিডিয়া ক্যাডেট স্কুল প্রভৃতি।
আর নীল দরিয়ার নামে আছে নীল দরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, নীল দরিয়া বিনোদন টিভি প্রভৃতি।
♦ চতরা নামে বিশ্বে আরও যতকিছু→
ক. লালমনিরহাটে চতরা নামে একটি নদী আছে এবং নড়াইল জেলাতেও চতরা নামে একটি নদী আছে।
খ. পশ্চিমবঙ্গে 'চতরা' নামে একটি জায়গা আছে এবং সেখানে 'দক্ষিণ চতরা উচ্চ বিদ্যালয়' নামে একটি নামকরা স্কুল আছে।
গ. ভারতের ঝাড়খণ্ড প্রদেশে 'চতরা' নামে একটি জেলা আছে।
ঘ. নেপালে 'চতরা' নামে একটি নদী ও তা সংলগ্ন একটি ছোট পর্যটন শহর আছে।
👉 সংযুক্তি—
ক. চতরা ইউনিয়নের ওয়েবসাইটে যেতে এখানে—ক্লিক—করুন।
খ. চতরা বিষয়ক উইকিপিডিয়ার পেজে যেতে এখানে—ক্লিক—করুন।
গ. 'নীল দরিয়ায় ইতিকথা' বইটি পেতে এখানে—ক্লিক—করুন।
ঘ. চতরার রোডম্যাপ মানচিত্র দেখতে এখানে—ক্লিক—করুন।
ঙ. ভ্রমণ গাইড সেবা পেতে এখানে—ক্লিক—করুন।
© সম্পাদনা: মেহেদী হাসান, বিএ অনার্স, এমএ (ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব), বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর; উদ্যোক্তা, চতরাপিডিয়া।
Note : যারা ব্রাউজার থেকে কিংবা অন্য অ্যাপ থেকে চতরাপিডিয়া ভিজিট করছেন তারা 'চতরাপিডিয়া' এর অ্যাপ ডাউনলোড করতে এখানে—ক্লিক—করুন।
Chatrapedia — Simplifying Life
ধন্যবাদ | মেহেদী হাসান
No comments:
Post a Comment